ধনী-গরিব বিভাজন না করে, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় জোর দিয়ে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মতামতকে প্রাধান্য দিলেই সাফল্য পাবে নয়া শিক্ষানীতি! - Get Breaking & Latest Bengali News Online

Breaking

মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট, ২০২০

ধনী-গরিব বিভাজন না করে, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় জোর দিয়ে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মতামতকে প্রাধান্য দিলেই সাফল্য পাবে নয়া শিক্ষানীতি!

নিউজ ডেস্ক: রাজ্যের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ‘নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি- ২০২০’ সম্পর্কে যে মতামত চেয়েছিলেন তার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য কমিটি যে লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছে সেটি সবার জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করা হলো। একই বক্তব্য ইংরেজিতে তর্জমা করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছেও পাঠানো হবে।
‘নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০’ পড়লে আগাগোড়া পুরোটাই ভুল কিংবা একেবারে অযৌক্তিক একথা কোনো ভাবেই মনে হবে না। বরং এই শিক্ষানীতির পাতায় পাতায় এমন সব কথা রয়েছে যেগুলি পড়লে মনে হবে শিক্ষাক্ষেত্রে এ এক আমূল পরিবর্তনের উদ্যোগ। যেমন, আগের ৬ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রকে বৃদ্ধি করে ৩ থেকে ১৮ করা হয়েছে। তিন বছর বয়স থেকে শিশুদের শিক্ষাকে নিশ্চিত করবার জন্য অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র গুলিকে অত্যাধুনিক রূপে গড়ে তোলার কথা বলা রয়েছে। এই কেন্দ্রগুলিতে থাকবে যথেষ্ট পরিমাণে খোলামেলা শ্রেণিকক্ষ, খেলার মাঠ, অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে আনন্দ মূলক ভাবে শিক্ষাদানের সামগ্রী, উন্নত মানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ, শিশুদের আকর্ষণীয় শিক্ষাঙ্গন। এছাড়া শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়মিত শিক্ষক নিয়োগ, ৩০/২৫ জন ছাত্র পিছু একজন করে শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি কথা বলা রয়েছে। এছাড়া বলা হয়েছে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, শিক্ষার কাঠামো ৫+৩+৩+৪, শিক্ষকদের মূল্যায়ন, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের উপর গুরুত্ব আরোপ, প্রচলিত কলা, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান বিভাগের অস্তিত্ব বিলোপ, ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা, শিক্ষায় জিডিপির হার ৬% করা, প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষার পরিবর্তে নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিকে নিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা, সেমিস্টার পদ্ধতি, বৃত্তিমূলক শিক্ষা, অনলাইন শিক্ষাকে গুরুত্ব, সংস্কৃতসহ ক্লাসিকাল ভাষার উপর জোর, ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব হ্রাস, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়কে আহ্বান, কেবল তৃতীয়, পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণীতে পরীক্ষার ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়গুলি উল্লেখ রয়েছে। শিক্ষানীতির ছত্রে ছত্রে সুন্দর সুন্দর কথা যেমন রয়েছে তেমনি বেশ কিছু ক্ষেত্রে সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিরাট এক প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। যেসব ভালো কথাগুলির উল্লেখ রয়েছে তার সাথে যদি তাকে বাস্তবায়ন করার বাধ্যবাধকতা না থাকে তাহলে সেই বক্তব্যের কোন মূল্য থাকে না। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে বিগত শিক্ষানীতিগুলির মধ্যেও সরকারি শিক্ষা পরিকাঠামো উন্নতির বহু কথা উল্লেখিত হয়েছিল। কিন্তু তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। এমন হলে এই শিক্ষানীতিও অতীতের অনেক শিক্ষানীতির মতোই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। এই শিক্ষা নীতির ভালো কথাগুলির আড়ালে যে অন্ধকারময় দিক গুলি সম্পর্কে আমরা আশঙ্কিত সেই বিষয়গুলি তুলে ধরবার চেষ্টা করছি এবং তার প্রতিকারে সকলকে সচেষ্ট হওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
১) অঙ্গনওয়াড়ি শিক্ষা:- নয়া শিক্ষানীতির মাধ্যমে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে তিন বছর বয়স থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা শুরু করার কথা বলা হয়েছে। এতদিন পর্যন্ত শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টি ও যত্নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। কিন্তু সরকার তাদের মাইনে বাড়ানো তো দূরে থাক, তাদের সরকারি ক্যাজুয়াল কর্মীর স্বীকৃতিটুকু দেয়নি। ফলে, আজও তারা সরকার নির্ধারিত বেতনটুকুও পায় না। এর মধ্যে তাদের জন্য নতুন ভূমিকা পুষ্টি প্রকল্পকে যেমন দুর্বল করবে তেমনি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে। এই কেন্দ্রগুলির বর্তমানে যা হাল তাতে কি যথেষ্ট পরিকাঠামো রয়েছে? যদিও এই শিক্ষানীতিতে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রকে ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, উন্নত মানের পরিকাঠামো, খেলাধুলার জায়গা এবং খেলার সামগ্রী, উন্নত মানের ক্লাসরুম, বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক কারুকার্য, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এবং শিক্ষক পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকবে। বর্তমানে সারা ভারতবর্ষে ৪০ লক্ষ বড় পাড়া রয়েছে কিন্তু অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ১৩ লক্ষ। ৩ বছরের শিশুদের জন্য কাছাকাছি কেন্দ্র না থাকলে এই সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হবে। শিক্ষার ভিত্তি হল প্রাথমিক শিক্ষা। তা যদি নড়বড়ে হয় তাহলে বৃহৎ কথার আড়ালে ‘পর্বত মূষিক প্রসব’ করবে। যেহেতু সরকারিভাবে তিন বছর বয়স থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা শুরু হচ্ছে এর ফলে সরকারি ব্যবস্থা যদি উপযুক্ত ভাবে গড়ে না ওঠে তাহলে শিক্ষা ব্যবসায়ীরা উন্নত পরিকাঠামো সহ শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তুলবে আর অর্থবানরা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে আরো বেশি করে দৌড়াতে বাধ্য হবে। পরিকাঠামো বিহীন সরকারি কেন্দ্রগুলোতে পড়ে থাকবে অসহায় দরিদ্র সাধারণ বাড়ির সন্তানরা। ‘এক দেশ এক শিক্ষা’ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে সবার আগে সার্বিকভাবে সরকারি পরিকাঠামো গড়ে তুলে তার ভিত্তিতে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দূর শিক্ষার মাধ্যমে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা কোনভাবেই কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে বলে মনে হয় না।
২) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা:- একইভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় রয়েছে। বিগত শিক্ষানীতি(১৯৮৬) বা শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯-এ বলা হয়েছিল প্রতিটি বিদ্যালয়কে আদর্শ বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হবে। কিন্তু আজও পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার কঙ্কালসার চেহারা প্রায় সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে যথাযথ বিল্ডিং নেই, খেলার মাঠ নেই, বাউন্ডারি ওয়াল নেই, স্মার্ট ক্লাসরুম নেই, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষাদান প্রক্রিয়াকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যায়নি। বিদ্যালয়ে আজও পর্যন্ত ঝাড়ুদার কিংবা নৈশপ্রহরী নেই। অনিয়মিত শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকের অভাব, শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি, শিক্ষাদান অপেক্ষা অন্যান্য কাজে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অধিকাংশ সময় নিয়োজিত রাখা ইত্যাদি প্রাথমিক শিক্ষাসহ মাধ্যমিক শিক্ষাকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা এভাবেই ক্রমশ ভেঙে পড়ছে। আর সে জায়গায় ব্যবসায়ীরা বেসরকারি বিদ্যালয় গড়ে তুলছে। শিক্ষা নীতির মাধ্যমে বহু ভাল কথার আড়ালে যদি এই আসল কাজ গুলি না করা হয় তাহলে বেসরকারি শিক্ষা আরো বেশি করে জাঁকিয়ে বসবে। অর্থ যার শিক্ষা তার – এটাই হবে ভবিতব্য। তাই সর্বাগ্রে সামগ্রিক শিক্ষার পরিকাঠামো ঢেলে সাজানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ECCE নিয়ে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হয়েছে, কিন্তু সমস্যা সমাধানে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। প্রাথমিক স্তরের পিছিয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলমুখী করতে বা প্রয়োজনীয় শিক্ষাদানের জন্য স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে যুদ্ধ জয় করা যায় না। ট্রেন্ড এবং স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।
৩) শিক্ষকদের ইনক্রিমেন্ট:- নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতির মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সিনিয়রিটির ভিত্তিতে প্রচলিত ইনক্রিমেন্ট বা প্রমোশনের পরিবর্তে পারফরমেন্স বা মূল্যায়নের ভিত্তিতে ইনক্রিমেন্ট বা প্রমোশনের কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে স্বজনপোষণ দুর্নীতির আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, দলীয় অনুশাসন ইত্যাদির ফলে এর প্রকৃত বাস্তবায়ন কি সম্ভব? বিদ্যালয়ে বা সরকারের শিক্ষাসংক্রান্ত অন্যায় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা বা প্রতিবাদ করলে তাঁর উপর খাঁড়া নেমে আসবে -এ কথা নিঃসন্দেহে জোর দিয়ে বলা যায়। ফলে এই ব্যবস্থা কোনো মতেই মেনে নেওয়া যায় না।
৪) শিক্ষার বাজেট:- নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০২০-র মাধ্যমে শিক্ষার জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের যোগান প্রয়োজন তা আসবে কি করে? শিক্ষাক্ষেত্রে জিডিপি ৬% করার কথা বলা হয়েছে – এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কেন্দ্র এবং রাজ্য মিলিয়ে বর্তমানে ৪.৩৪। শিক্ষাখাতে কেন্দ্রীয় বাজেটের ১০% খরচ করার দাবি দীর্ঘদিনের। বিগত শিক্ষা কমিশন গুলিতেও একই কথা বলা হয়েছিল কিন্তু প্রতিবছর শিক্ষায় বরাদ্দকৃত অর্থ কমানো হচ্ছে অথচ কিভাবে জিডিপি ৬ তে নিয়ে যাওয়া হবে সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। আমাদের আশঙ্কা বৃহৎ ধনশালীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হবে যার ফলে শিক্ষা আরো বেশি করে বেসরকারি পণ্যে পরিণত হবে। ফলে উচ্চবিত্তদের সন্তানরা অর্থের বিনিময়ে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করবে। সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাবে শিক্ষা। শিক্ষার সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটের ১০% অর্থ ব্যয় করার নীতিগত সিদ্ধান্ত সরকারকে ঘোষণা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য রাজ্য সরকারের ভূমিকাও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। রাজ্য সরকারকেও সামগ্রিক পরিকাঠামোর উন্নয়নে শিক্ষা খাতে যথেষ্ট পরিমাণে ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে।বেঙ্গালুরুর ‘সেন্টার ফর বাজেট অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজ’এর পক্ষ থেকে জোৎস্না ঝা ও মধুসূদন রাও কৃত সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় বাজেটে (২০১৪-১৫) শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল জিডিপি’র ০.৫৩ শতাংশ, ২০১৭-১৮’এ ০.৪৮ শতাংশ, ২০১৯-২০’তে ০.৪৫ শতাংশ এবং ২০২০-২১’এ ০.৪৪ শতাংশ। এর সঙ্গে রাজ্যের ব্যয় বরাদ্দ যুক্ত করা হলেও তা জিডিপি’র ৪ শতাংশের কাছাকাছি। ফলে, আরও বেশি বিদেশি পুঁজির প্রবেশের পথ প্রশস্ত হবে। বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া আরও দ্রুত হবে।
৫) কেন্দ্রীয়করণের ঝোঁক:- শিক্ষা যুগ্ম তালিকায় রয়েছে। আলাপ-আলোচনা, সমালোচনা বা প্রতিবাদের রাস্তা বন্ধ করে, রাজ্য গুলির সাথে আলোচনা না করে, সংসদকে এড়িয়ে করোনার মতো অতিমারি ভাইরাসের আক্রমণে যখন দেশ জর্জরিত তখন এই সিদ্ধান্ত কেবল মন্ত্রিসভায় পাস করিয়ে নেওয়া হলো। এটি অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ। এই শিক্ষা নীতির সংশোধনী চেয়ে প্রায় দু’লক্ষ সাজেশন জমা পড়েছিল। অধিকাংশ বিরুদ্ধ মত প্রত্যাক্ষিত হয়েছে। কেবল বিদেশি অনুকরণ নয়, বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক, শিক্ষাবিদ সকলের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে সারা দেশের উপযোগী করে তুলতে হবে। প্রয়োজনে বিতর্ক হোক। এর মধ্য দিয়ে সত্য নির্ধারণ করতে হবে। এই শিক্ষা নীতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয়করণের ঝোঁক সর্বত্র লক্ষ্য করা গিয়েছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক কারণে বিভিন্ন রাজ্যের ভিন্নতা অনুযায়ী শিক্ষার বিষয়টি নির্ভর করে। বারংবার বলা হচ্ছে শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ লাইফ এন্ড টাইট হবে অথচ পুরনো রেগুলেটরি বডি গুলোকে সরিয়ে নতুনতর কেন্দ্রিয় রেগুলেটরি বডি নিয়ে আসা হচ্ছে। বিশেষ করে বলা যায় NACSE এর গঠন আদতে রাজ্যগুলিকে শিক্ষা ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের মতো করে চলতে বাধ্য করবে বলে মনে হয়েছে।
৬) বিগত শিক্ষা নীতির ত্রুটিগুলির মূল্যায়ন দরকার:- প্রকৃতই যদি শিক্ষার খোলনলচে বদলে ফেলে সকলের কল্যাণে নয়া শিক্ষা নীতি গ্রহণ করার পরিকল্পনা থাকে তাহলে বিগত দিনের শিক্ষানীতি বা শিক্ষা ব্যবস্থা কেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে বা তার ত্রুটি গুলি কি সেগুলি এই শিক্ষানীতিতে আলোকপাত করা হত। সেই ত্রুটিগুলি দূর করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই আসল কাজটি হত। কিন্তু তা করা হলো না। তা না করে নতুন আর একটি শিক্ষানীতি চাপিয়ে দেওয়া হল। একইভাবে সুন্দর কথার আড়ালে বাস্তবায়নের দিকটি অবহেলিত থেকেই যাবে বলে আশঙ্কা। যেমন রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট – ২০০৯ অনুযায়ী সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আদর্শ পরিকাঠামো যুক্ত রূপান্তরিত করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তা প্রায় কথার কথা হয়ে থেকে গিয়েছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ ফেল প্রথা তুলে দেওয়া হলো কিন্তু পরিকাঠামোর উন্নতি হলো না। একইভাবে আজও যদি বাস্তবায়নের দিকটি এড়িয়ে গিয়ে শিক্ষানীতির কিছু বিষয় চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে একইভাবে এই শিক্ষানীতিও ব্যর্থ হবে।
৭)শিক্ষাকে বেসরকারিকরণের গ্রাস থেকে রক্ষার কোনো উদ্যোগ নেই:- শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্নরূপে বেসরকারিকরণের গ্রাস থেকে রক্ষা করার কোনো পরিকল্পনা এই শিক্ষা নীতির মধ্যে নেই। শিক্ষার সম্পূর্ণ দায়ভার সরকার গ্রহণ না করলে এই শিক্ষানীতি বাস্তবে সকল মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারবে না। দেশের বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে অবসান ঘটিয়ে শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে সরকারিকরণ করতে হবে। নাহলে কোনভাবেই সারা দেশের শিক্ষানীতি সফল হতে পারবে না।
৮) পরীক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি, ড্রপ আউট বাড়বে:- অবাধ প্রমোশনের জন্য অন্য শ্রেণিতে পাশ ফেল প্রথা না থাকলেও তৃতীয়, পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়াদের মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অন্য শ্রেণীতে কার্যকরী পরীক্ষা না থাকায় অবাধ প্রমোশনের পর হঠাৎ করে এই শ্রেণি পরীক্ষায় অনেকেই অকৃতকার্য হবে। এতে শিক্ষার গুণগতমান যেমন কমবে তেমনি ড্রপ আউটের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
৯) মাধ্যমিক শিক্ষার বিলোপ মৌলিক শিক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, ড্রপ-আউট বাড়বে:- মাধ্যমিক শিক্ষার গুরুত্বকে কোনভাবেই হ্রাস করা ঠিক নয়। এই পরীক্ষার পর বহু ছাত্র-ছাত্রীই ড্রপ আউট হয়ে যায়। মাধ্যমিক শিক্ষার পর বিভিন্ন কাজে প্রবেশ করার একটা সুযোগ ছিল। বর্তমান কাঠামোকে বদলে দিয়ে যদি সেমিস্টার পদ্ধতিতে নবম, দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণীর ভিত্তিতে মাধ্যমিক সার্টিফিকেট দেওয়া হয় তাহলে তা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ড্রপ আউটের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া বৃত্তিমূলক শিক্ষাসহ বহু বিষয়কে শিক্ষার বিষয় হিসাবে ঢুকিয়ে দেওয়ার ফলে গোড়ার প্রধান শিক্ষা ব্যাহত হবে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত আটটি সেমিস্টারে পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই সেমিস্টার ব্যবস্থা শিক্ষার ভিত্তিকে দুর্বল করে দেবে। সিলেবাসের ছোট ছোট অংশ ভিত্তিক পরীক্ষা হওয়ার ফলে সামগ্রিক সিলেবাসের জ্ঞান হ্রাস পাবে। মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা তুলে দিয়ে নবম, দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণীর ভিত্তিতে মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হলে বর্তমানে সমস্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলিকে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় বহু(৪০টি) বিষয়ে শিক্ষকসহ উন্নত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। আগে তা না করে হঠাৎ করে এই শিক্ষা ব্যবস্থা চাপিয়ে দিলে তা মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। এর সুযোগ নেবে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসায়ীরা।
১০) অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা:- নয়া শিক্ষা নীতির মাধ্যমে অনলাইন ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যেই আমরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে দেখতে পেয়েছি প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনের আওতার বাইরে থেকে গিয়েছে। বিষয়টি পুরোপুরি আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। এর বাস্তবায়ন কি করে সম্ভব? সাধারণ বাড়ির সন্তানরা এর মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ পাবে না। ৫০ শতাংশের বেশি পড়ুয়াকে এই ব্যবস্থায় আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। স্নাতক স্তরে ১০০% অনলাইন শিক্ষা ভিত্তিক ডিগ্রী প্রদানে জোর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিবর্তে অনলাইন শিক্ষার দিকে শিক্ষাকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। এর ফলে সরকারকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে না, লাইব্রেরী-ল্যাবরেটরী গড়ে তুলতে হবে না, সর্বোপরি এত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে না। ধনশালীরা অর্থের বিনিময়ে ইন্টারনেট, ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোনের সাহায্যে শিক্ষা গ্রহণ করবে। শিক্ষা যে কেবল যন্ত্রনির্ভর নয়, ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের সান্নিধ্য সার্বিক শিক্ষার ভিত মজবুত করে – তাকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা কোনভাবেই বিদ্যালয়, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না। অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে যেন গ্রাস না করে সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
১১) ভাষা শিক্ষা:- নতুন শিক্ষানীতিতে তিনটি ভাষা শিক্ষার কথা বলা হয়েছে যার মধ্যে দুটি ভাষাকে হতে হবে ভারতীয়। তার মানে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার গুরুত্বকে হ্রাস করার চেষ্টা রয়েছে এই নীতিতে। আমরা মনে করি, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাকে প্রথম থেকে গুরুত্ব সহকারে পড়াতে হবে। তা না হলে কোনো শিক্ষার্থীর শক্ত ভিত গড়ে উঠতে পারবে না। কারণ ঐতিহাসিক কারণেই শিক্ষার সমস্ত ক্ষেত্রের জ্ঞানের আকর রয়েছে এই ভাষার মধ্যেই। তা থেকে কোনো ভাবেই বঞ্চিত করা যাবেনা ছাত্র-ছাত্রীদের। সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলির ক্ষেত্রে এক নিয়ম আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে আর এক নিয়ম যদি হয় তাহলে পরোক্ষভাবে বেসরকারী শিক্ষার দিকে মানুষকে ঠেলে দেওয়া হবে।
১২) পরিকাঠামোর অভাবে বেসরকারি শিক্ষার রমরমা বাড়বে:- তিন বছর বয়স থেকে শিশু শিক্ষার বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই সময় থেকে সরকারিভাবে সারা দেশজুড়ে শিক্ষার ব্যাপক পরিকাঠামো তৈরি করতে না পারলে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটি নেবে। বলাবাহুল্য শিক্ষার এই প্রারম্ভিক স্তরটির যা করুণ দশা তাতে শুরু থেকেই বেসরকারি শিক্ষা জাঁকিয়ে বসবে। পরিণতিতে বিরাট অংশের সাধারণ গরিব বাড়ির সন্তানরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে বৈষম্য তৈরি হবে।
১৩) বিদ্যালয় একীকরণ:- CONSOLIDATION OF SCHOOLS একটি সম্পূর্ণ ভুল চিন্তা ভাবনা। বেশি দূরত্ব, কম ছাত্র ও শিক্ষক সম্পন্ন স্কুলগুলির সমস্যা সমাধানের জন্য ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা একমাত্র পথ।
১৪) সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষায় একই নীতি প্রয়োগ হয় না:- বেশ কিছু অবাস্তব শিক্ষানীতি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির উপর চাপিয়ে দেওয়া হলেও বাস্তবে দেখা যায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রে তা কার্যকরী হয় না। ফলে একই দেশে দু’রকম শিক্ষা পদ্ধতি চলতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বিগত দিনে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইংরেজি বা পাশ ফেল প্রথা তুলে দেওয়া হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে তা বহাল থাকে। তার ফলে ধনী বাড়ির সন্তানরা অর্থের বিনিময়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আর বঞ্চিত থেকে যাবে সাধারন গরিব বাড়ির বিরাট অংশের ছাত্র-ছাত্রীরা। নয়া শিক্ষানীতিতে এর অবসান ঘটানোর কোনো পরিকল্পনা নেই।
১৫) মূল্যায়ন পদ্ধতি:- পরীক্ষা ব্যবস্থার মূল্যায়ন পদ্ধতির কেন্দ্রীকরণের জন্য একটি নীতি তৈরি হবে যার নাম PARAKH (Performance Assessment, Review and Analysis of Knowledge for Holistic Development)। আর সেই মূল্যায়ন পদ্ধতি মেনে তৃতীয়, পঞ্চম, অষ্টম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণিতে মড্যুলার ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হবে। এর পিছনে দুটো উদ্দেশ্য আছে। একটি হল, ভারতের মতো বহু ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির দেশে রাজ্য স্তরের বোর্ডগুলি সেই রাজ্যের বৈশিষ্ট্য সমূহ মাথায় রেখে যে ভাবে পাঠ্যক্রম তৈরি, পরীক্ষা পরিচালনা করছিল, তাকে ধ্বংস করে সংঘ পরিবারের দাবি মেনে ‘এক দেশ, এক শিক্ষা’ চালু করা। দ্বিতীয়টি হল, ড্রপ-আউটের সংখ্যাকে লুকিয়ে রাখা। ‘অল ইন্ডিয়া ফোরাম ফর রাইট টু এডুকেশন’ প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রথম শ্রেণিতে যত শিক্ষার্থী অ্যাডমিশন নেয় তার মধ্যে আদিবাসীদের ৬ শতাংশ, তপশিলি জাতিদের ৮ শতাংশ, ওবিসিদের ১০ শতাংশ ও সংখ্যালঘুদের ৯ শতাংশ দ্বাদশ শ্রেণিতে আসে। বাকিরা মাঝপথে পড়া ছেড়ে দেয়। এই বিশাল সংখ্যক ড্রপআউট’দের লুকোবার জন্য ‘Entry’, ‘Exit’, ‘Flexibility’ প্রভৃতি শব্দের আড়ালে ড্রপ-আউটকে ন্যায্যতা দেওয়া হবে।
১৬) বিষয়ে শিক্ষার গুরুত্ব কমবে:- বলা হয়েছে বর্তমানের কলা, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান বিভাগ আর থাকছে না। সবকিছুতে একত্রিত করে দেওয়া হবে। যে যা খুশি বিষয় নিয়ে পড়তে পারবে। পদার্থবিদ্যার সঙ্গে গণিত কিংবা রসায়নের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত কিন্তু তা না নিয়ে যদি সঙ্গীত কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো বিষয় রাখা হয় তাহলে পদার্থবিদ্যার মতো মৌলিক শিক্ষার কোনো গুরুত্ব থাকবে কি? এর দ্বারা বিষয় শিক্ষার গভীরতাকে হ্রাস করে দেওয়া হবে। মৌলিক শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
১৭) ক্লাসিকাল ল্যাঙ্গুয়েজে জোর, উন্নত ভাষা শিক্ষায় গুরুত্ব হ্রাস:- সংস্কৃত ভাষার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ক্লাসিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ হিসাবে তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালায়ালাম, ওড়িয়া, পালি, পার্শিয়ান, প্রাকৃত ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্রত্যেকে তার পছন্দ অনুযায়ী ভাষা শিক্ষা অর্জন করতেই পারে। তাতে বাধা দেওয়ার অধিকার কারো নেই। কোন ভাষা শিক্ষাকে আমরা বেশি গুরুত্ব দেব? যে ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, আধুনিক চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে সেই ভাষাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে দেশীয় ভাষাগুলির মধ্যে বাংলা ভাষাকে কোনভাবেই খাটো করে দেখা চলে না। আমরা সকলেই জানি ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় নবজাগরণের পীঠস্থান ছিল অবিভক্ত বাংলা। এই ভাষাতেই ভারতীয় নবজাগরণের বিকাশ ঘটেছিল। এই ভাষাতেই রামমোহন, বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ প্রমুখগণ। ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার গুরুত্বকে কোনভাবেই অস্বীকার করা চলে না। বাংলা ভাষার স্বীকৃতি শিক্ষানীতিতে কোথাও নেই। এটি অত্যন্ত দুঃখের। ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাকেও আবশ্যিক করতেই হবে। স্বয়ং বিদ্যাসাগর মশাই নিজে সংস্কৃতে দিকপাল হওয়া সত্ত্বেও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ইংরেজি ভাষা, ফিজিকস, গণিত এবং আধুনিক যুক্তিবিদ্যা পড়ানোর পক্ষে সুপারিশ করেছিলেন। এর সাথে মাতৃভাষা শিক্ষাকেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
১৮) শিশুশ্রমকে উৎসাহিত করবে:- যেখানে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স সম্পন্ন করে কাজের জন্য হাহাকার করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে বিদ্যালয় স্তরে বৃত্তিমূলক শিক্ষা কতটুকু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে তা যথেষ্ট সন্দেহের। তাছাড়া বিশ্বায়নের যুগে এইসব শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে কাজ শিখে খোলাবাজারে বৃহৎ শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কতটুকু পেরে উঠবে তা সহজে অনুমেয়। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে থেকে বৃত্তিমূলক শিক্ষার মধ্যে প্রবেশ করলে গোড়ার মৌলিক শিক্ষা ব্যাহত হবে। তাছাড়া আমাদের আশঙ্কা এর মাধ্যমে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। পরোক্ষভাবে এই শিক্ষানীতি শিশুশ্রমকে উৎসাহিত করবে। মাধ্যমিক পরবর্তী পর্যায়ে তা রাখা যেতেই পারে।
১৯) শিক্ষায় বাণিজ্যের প্রসার বৃদ্ধি পাবে:- বিশ্বের উন্নত মানের ১০০ টি বিশ্ববিদ্যালয়কে জানানো হবে ডিগ্রী প্রদানের জন্য। তারা মূলত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে ভুরি ভুরি টাকার বিনিময়ে ডিগ্রী প্রদান করবে। ধনশালী পরিবারের সন্তানরা অর্থের বিনিময়ে সেই ডিগ্রি কিনবে। এই শিক্ষার সঙ্গে সাধারণ বাড়ির মেধাসম্পন্ন পড়ুয়াদের কোনো সম্পর্ক নেই। ‘এক দেশ এক শিক্ষা’ কার্যত কথার কথায় পরিণত হবে। তিনটি স্তরে অসম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন জাতীয় ও দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
২০) অন্য ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থাকে অস্বীকার:- সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও সরকারিভাবে তপশিলি উপজাতি অধ্যুষিত আশ্রম শালা ব্যতীত অন্য জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়ভার অস্বীকার করা হয়েছে ( প্যারা 1.8 পেজ 7) যা পেজ 5 এর para 0.13 পি বর্ণিত রেস্পেক্ট ফর ডাইভারসিটি এন্ড রেস্পেক্ট ফর লোকাল কন্টেক্সট এর বিরোধী।
২১) আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন জরুরি:- ‘এক দেশ এক শিক্ষা’ কথাটি শুনতে হয়তো খুব ভালো কিন্তু যে দেশে ৭৩ ভাগ সম্পত্তির মালিক ১ ভাগ মানুষের হাতে থাকে সে দেশে এই কথাটি অতি মূল্যবান অলংকারের মতো কিছু মানুষের শোভা বৃদ্ধির জন্য নয় কি? সারাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি সম্পূর্ণরূপে সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসা যায় তবেই এ কথার গুরুত্ব থাকে। না হলে কেবল তা কথার কথা।
সামগ্রিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হলে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা তুলে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে উন্নত পরিকাঠামোর সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন রূপে সাজিয়ে তুলতে হবে। তবেই শিক্ষা ধনী বা গরীব বাড়ির সন্তানদের কাছে বৃষ্টির ধারার মতো কিংবা সূর্যের কিরণের মতো সমানভাবে পৌঁছে যাবে। শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে ধনী কিংবা গরিবের ক্ষেত্রে কোন ভাবেই বিভাজন মেনে নেওয়া যায় না। আর শিক্ষা নীতি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যাঁরা হাতে-কলমে শিক্ষা দান করছেন সেই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষা নীতি গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষানীতির এই আসল কাজটিকে এড়িয়ে গিয়ে কোনো শিক্ষানীতি সফল হতে পারে না। আমরা নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির উল্লেখিত আলোচনার বিভিন্ন দিকগুলির যৌক্তিকতা বিচার করে সংশোধনী আনার দাবি জানাচ্ছি।
নমস্কারান্তে
সভাপতি: বিশ্বজিৎ মিত্র
রাজ্য সম্পাদক: কিংকর অধিকারী
শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি।
The post ধনী-গরিব বিভাজন না করে, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় জোর দিয়ে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মতামতকে প্রাধান্য দিলেই সাফল্য পাবে নয়া শিক্ষানীতি! appeared first on বিশ্ব বার্তা.


from হেড লাইনস – বিশ্ব বার্তা https://ift.tt/2Q3qmBK

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন