নিউজ ডেস্ক: শিক্ষক ঐক্য মুক্তমঞ্চের রাজ্য কোর কমিটি আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে সংগঠনের পক্ষ থেকে রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে একটা আবেদন পত্র পাঠানো হবে। বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে, আমরা সাংগঠনিক ভাবে রাজ্য প্রশাসনের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, COVID19 এর বিরুদ্ধে এই লড়াইটা লড়তে চাই। সেই কারণে রাজ্যের মাননীয়া মূখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে অবেদন জানায় যে, সমস্ত সরকারি বেতনভোগী কর্মচারীদের আগামী মাসগুলোর মাসিক বেতন থেকে ২৫% কেটে নিয়ে দুর্গত এবং দরিদ্রদের সাহায্য করতে, যতদিন পর্যন্ত এই আপদকালীন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হচ্ছে। সাথে আরও বিবিধ বিষয় উল্লেখ আছে।
কিন্তু খুব অবাক হয়ে দেখলাম, রাজ্যের শিক্ষক শিক্ষিকাদের প্রতিক্রিয়া। যদিও আবেদন ছিল সকল সরকারি কর্মচারীদের বেতন থেকে কেটে নেওয়ার জন্য, তবুও কেবলমাত্র শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়াই পেয়েছি। কারণ আমি নিজে একজন প্রাথমিক শিক্ষক। তাই আমার বন্ধু বৃত্তের বেশিরভাগই শিক্ষক। ফেসবুক কমেন্টে, ব্যক্তিগত হোয়াটসএপে, ম্যাসেঞ্জারে এমনকি সরাসরি ফোনে কটুক্তি করতেও পিছপা হলোনা অনেকেই।
বেশিরভাগ মানুষেরই প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হলো, আমরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে যেহেতু সরকারি চাকরি পেয়েছি, তাই এই পরিস্থিতিতে আমাদেরই একমাত্র বাঁচার অধিকার আছে। প্রান্তিক কৃষক, পরিযায়ী শ্রমিক, কলকারখানার মজুর, ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ী ইত্যাদি যাদের সেই যোগ্যতা নেই, তারা বর্তমান পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার জন্য যোগ্যতম নন। তাই অভিযোজনের তত্ত্ব অনুযায়ী তাদের মরে যাওয়াই উচিৎ। আমরা যেহেতু সরকারি কর্মচারী, তাই আমরা আগামী একমাস বা তার বেশি সময় ধরে হোম কোয়ারেন্টাইন উপভোগ করবো, এবং পাশের বাড়ির বা পাশের পাড়ার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীটা অভূক্ত এবং অর্ধভূক্ত থাকবে। আমার বাড়ির শিশুটি সরকারি কর্মচারীর ঘরে জন্ম নেওয়ার সুবাদে, অন্যান্য দিনের মতোই হেলথ ড্রিংকস খেয়ে তার দিনটা শুরু করলেও পাশের বাড়ির শিশুটি একগ্লাস ফ্যানও পাবেনা, কারণ তার বাবা যে কারখানায় কাজ করতো সেটা বিগত দু সপ্তাহ বন্ধ আছে। কর্মকার পাড়ার সেই পরিবারের খবর কেউ নেবেনা, কারণ তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেটি গত সপ্তাহে কেরালা থেকে ফিরেছে সবকিছু খুইয়ে।
আমার শিক্ষক বন্ধুদের বোঝাতে পারলাম না যে এমনটা কিন্তু বেশিদিন চলবে না। চলতে পারেনা। ঐ মানুষগুলো প্রশ্ন এবং প্রতিবাদ করবেই যে সরকারি কর্মচারীদের মাসিক বেতনটাও তাদের প্রত্যেকের দেওয়া করের টাকাতেই হয়। কেবলমাত্র তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে যোগ্য বলে, তারা এই স্বেচ্ছানিবার্সন উপভোগ করবে, আর যাদের করের টাকায় করবে তারা অর্ধভূক্ত বা অভূক্ত থাকবে, এটা দীর্ঘদিন মেনে নেবেনা সমাজ। দুদিন খালি পেটে শোয়ার পর, তৃতীয় দিন তারা সামনের রেশন এবং মুদির দোকানে ভাঙচুর চালাবে। তাতেও খিদে না মিটলে, চতুর্থ দিন আমার আপনার মতো সরকারি কর্মচারীর রান্নাঘরে হানা দেবে। প্রশাসন ও সেদিন হাল ছেড়ে দিয়ে, নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। এই কাল্পনিক দৃশ্য হয়তো আপনারা অনেকেই কল্পনাও করেননি এখনো। কিন্তু ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখে নিন, অসংখ্য এইধরনের উদাহরন পাবেন। তার জন্য আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে বা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে না পারলে, ইতিহাসও কিন্তু ক্ষমা করবে না।
আরও বিস্মিত হয়েছিলাম তাদের বিরোধিতা করতে দেখে, যারা দিনবদলের স্বপ্ন ফেরি করতো। যারা যৌথ খামারে একসাথে বসবাসের গল্প শোনাতো। যারা কাঁটাতারহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাতো মানুষকে। জানিনা তাদের এই আত্ম-বিস্মৃতির কারণ কি। যে স্বপ্নটা তারা অন্যকে দেখাতো, সেটাতে কি তারা নিজেরাই বিশ্বাস করতো না।
চেষ্টা করছি এবং করে যাবো সাংগঠনিক ভাবে, নিজেকে কেবলমাত্র মানুষ হিসেবে সবার প্রথম পরিচয় দেওয়ার। ভেবেছিলাম এই দুর্দিনে সমাজের কাছে প্রমান করে দেবো যে সরকারি কর্মচারীরা তথা শিক্ষকরা কেবলমাত্র নিজেদের বেতন বঞ্চনার বিরুদ্ধেই লড়াই করেনা, সামাজিক বিপদের দিনেও সমানভাবে লড়াই করে।
আমরা সাংগঠনিক ভাবে আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। বাকিটা আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।
(লিখেছেন শিক্ষক ও সমাজকর্মী তথা পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক মইদুল ইসলাম)
The post “অবাক পৃথিবী, অবাক করলে তুমি”: মইদুল ইসলাম appeared first on বিশ্ব বার্তা.
from হেড লাইনস – বিশ্ব বার্তা https://ift.tt/2WZvdIQ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন